বিশেষ সংবাদদাতা :
পেকুয়ায় নৌবাহিনীর নির্মিতব্য সাবমেরিন স্টেশনের নামে অধিগ্রহণকরা জমিতে লবণ চাষ নিয়ে স্থানীয় দুটি গ্রুপ মুখোমুখী অবস্থান নিয়েছে। উপকূলীয় মগনামা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এসব জমি লীজ নেয়া হয়েছে প্রচার করে লবণ চাষে ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে। অধিগ্রহণের আওতায় পড়া জমির মালিক পক্ষও আরেকটি গ্রুপ হয়ে লবণ চাষে নামতে জড়ো হয়েছে।
এক মৌসুমে প্রায় ৬ কোটি টাকার লবণ উৎপাদন হবে জেনে সুবিধাভোগী সবাই যে যার অবস্থান থেকে সরতে অনড়। এতে যেকোন মূহুর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেঁধে খুনের ঘটনাও ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বোদ্ধামহল।
সূত্র জানায়, নৌবাহিনীর সাবমেরিন স্টেশন স্থাপনের জন্য পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ৪১৯ দশমিক ৮৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। জমিগুলোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণের টাকা মালিকদের কাছে ইতিমধ্যে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। জমিগুলো বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে নৌ-বাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে। নৌবাহিনী সেসব জমির চারপাশে কাটা তারের ঘেরা দিয়ে দখলে নিয়েছে। আর সাবমেরিন স্টেশন স্থাপন কাজের ধীর গতিকে পূঁজি করে এসব জমিতে আবাদ শুরু করেছে প্রভাবশালীরা।
স্থানীয় চাষীদের মতে, অধিগ্রহণ করা মোট জমিতে ৩১৩ একর চাষাবাদ যোগ্য। এর মাঝে এলাকার লাগোয়া ৩১০একর জমিতে চাষের তোড়জোড় চলছে। যাতে প্রায় সোয়া ২ লাখ মণ লবণ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। টাকার হিসেবে উৎপাদিত লবণের মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৬ কোটি টাকা। তাই ইজারার ভূয়া তথ্য প্রচার করে মাঠ লবণ উৎপাদন উপযোগী করছে তারা। মাঠে নামাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য জায়েদুল হক, আশু মাঝি, বাদশা মাঝি ও সাবেক ইউপি সদস্য শাহ আলম, সলিম, মনির, বেলাল, হাবিব, নুর আহম্মদ, আকতার, গিয়াস উদ্দিন ও আবুল হোসেনসহ আরো বেশ কয়েকজন। তারা ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াসিমের অনুসারী বলে এলাকায় পরিচিত। আর নিজেদের ক্ষমতা জানান দিতে চাষে নামা গ্রুপটি প্রতি রাতে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। তাদের মোকাবেলায় জমির মালিকরাও রণপ্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দাবি করেছে স্থানীয় সূত্র।
স্থানীয়রা জানান, সাবমেরিন স্টেশনের কাজ ধীরগতি হওয়ায় চাষাবাদ যোগ্য এসব জমি চলতি মৌসুমে চাষের জন্য লীজ পেতে জমির মালিকসহ চকরিয়া-পেকুয়ার সাংসদ হাজী মো. ইলিয়াছ, পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজু, মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা শরাফত উল¬াহ ওয়াসিম, কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগ সদস্য আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতা রুস্তম আলী, মগনামা ইউনিয়ন সেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি সোলতান মাহমুদ রিপন, চকরিয়ার ঢেমুশিয়া ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান আজম উদ্দিন, বিএনপি নেতা রিদুয়ানুল হক, জমির মালিক তানভীর হাসান চৌধুরী, কাজের মো. কাইছার, মইন উদ্দিন প্রমূখ। প্রভাবশালীদের বেশ কয়েকটি পক্ষ কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসক সব আবেদনই নাকচ করেন। সেখানে প্রত্যাখাত হয়ে লীজের জন্য আবেদন করা হয় নৌবাহিনীর কাছে। সেখানে কারো আবেদন গ্রহণ করা হয়নি বলে জানাগেছে।
স্থানীয় সূত্র আরো জানায়, লীজ আবেদন নাকচ হওয়ায় অধিকাংশ আবেদনকারী লবণ আবাদ থেকে সরে গেলেও বর্তমানে নৌবাহিনীর মালিকানাধীন এসব জমির প্রায় ৩১০ একর অবৈধভাবে লাগিয়ত দিয়েছেন মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল¬াহ ওয়াসিম। আর যারা এখন চাষে নেমেছেন তারা চেয়ারম্যান থেকে লাগিত নেয়ার কথাই বলছেন। এদের অনেকেই চেয়ারম্যান ওয়াসিমের লোক বলে পরিচিত।
ভূমি অধিগ্রহণ আইন মতে, অধিগ্রহণ করা জমিতে নির্দিষ্ট প্রকল্প কাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত ভূমির মালিক সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে চাষাবাদ করতে পারেন। আইনেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পেকুয়ার এসব জমিতে জোরপূর্বক অনুপ্রবেশ করে প্রভাবশালী চক্রটি।
মগনামা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি খায়রুল এনাম অভিযোগ করে বলেন, চক্রটির এ অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ যাতে সোচ্চার হতে সাহস না পায়, সেজন্যে পুরো মগনামা জুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে সশস্ত্র বাহিনী। তারা প্রত্যেক রাতেই ফাকা গুলিবর্ষণ করে ভীতি ছড়াচ্ছে মগনামায়। স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে রাখায় সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপটির বিরুদ্ধে কেউ টুশব্দটি করেনা।
তিনি আরো বলেন, ধানের শীষ প্রতীকে সাবেক শিবির ক্যাডার ওয়াসিম চেয়ারম্যান হলেও বর্তমানে সুবিধাভোগী আওয়ামীলীগ নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে বিনাবাধায় সব অপকর্ম করছেন তিনি। এসব নেতাদের মাঝে অনেকে তার রক্তের আত্মীয়ও রয়েছেন।
কক্সবাজার জেলা পরিষদ সদস্য ও পেকুয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের জবর দখল করতে মগনামায় ব্যাপকহারে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ করেছে চেয়ারম্যান ওয়াসিম বাহিনী। তারা পুরো মগনামাবাসীকে জিম্মি করে রেখেছে। এসব অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষন করেন তিনি।
পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজু বলেন, সরকারি কাজে এখই ব্যবহার না হলে জমিগুলো পতিত না রাখায় ভালো। তবে মধ্যস্বত্বভেীদের না দিয়ে জমির প্রকৃত মালিকদের চষাবাদের অনুমতি দিলে ক্ষতিগ্রস্তরা উপকৃত হবে।
চাষাবাদ জানতে নৌ-বাহিনীর চট্টগ্রাম কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যতটুকু জানি পেকুয়ায় অধিগ্রহণ হওয়া জমি লবণ চাষে কাউকে ইজারা দেয়া হয়নি। কেউ চাষে নামলে এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পেকুয়া ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিমের বলেন, নৌবাহিনী জমিগুলো কাউকে ইজারা দেয়নি। আমিও কাউকে চাষাবদ করতে লাগিয়ত দিইনি। অধিগ্রহণে আমাদের মালিকানাধীন যেসব জমি পড়েছে তা আমরা চাষ করছি। বাকিগুলোর খবর আমি জানিনা। আমার কোন বাহিনী নেই। গোলাগুলির বিষয়টি আমি জানিনা।
পেকুয়া থানার ওসি জহিরুল ইসলাম খান বলেন, পেকুয়াতে মগনামা এলাকাটা একটু ক্রিটিক্যাল। তবে, নৌবাহিনীর জমি এলাকায় গোলাগুলির বিষয়ে কেউ অভিযোগ দেয়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, নৌবাহিনীর জন্য অধিগ্রহণ করা জমি কাউকে চাষ করতে ইজারা দেয়া হয়নি। এসব জমির দেখভালের দায়িত্ব একণ নৌ কর্তৃপক্ষের। স্বার্থন্বেষী কেউ অনুপ্রবেশ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাইলে আমরা আইনী সহায়তা দেব।
পাঠকের মতামত: